আমার আমি

ইমন রেজা'র খেরোখাতা

আমার আজকের পাঠ: জানুয়ারি ৩১, ২০১৩ ইং

কবিতা পড়েন কিন্তু বেকেরের নাম শোনেননি, স্প্যানিশ-ভাষী জগতে এমন পাঠক খুব কমই আছেন। তাঁর কবিতা, বিশেষ করে তার ‘বাদামি চড়ুই পাখি ফিরে আসবে’ মুখস্থ বলে দিতে পারেন অনেকেই, আবার এমন শ্রোতাও আছেন যাঁরা তাঁর কাব্যাংশ গান হিসেবে শুনে আসছেন, হয়তো জানেন না তা আসলে বেকেরেরই কবিতার অংশবিশেষ। যেমন—‘রিমা ৩৮’ স্প্যানিশ একটি গানের অংশ হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে বহু দিন ধরে অর্থাৎ শুধু কাব্য হিসেবেই নয়, গানেও গোটা স্প্যানিশ জগতে ছড়িয়ে আছে বেকেরের পরিচিতি। বেকেরের কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ সারল্য, ছন্দ-স্পন্দন, সুমিষ্ট-বিষাদ কাব্যময়তা আর পরিশীলিত সংক্ষিপ্ততা। স্প্যানিশ সাহিত্যে তিনি বিবেচিত হয়ে আছেন এক বিলম্বিত রোমান্টিক কবি হিসেবে। রোমান্টিসিজমের সামগ্রিক মহত্ত্বকে তিনি একাই
সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রকাশ করেছেন।
দারিদ্র্য ও দুর্ভোগ ছিল বেকেরের চিরকালের সঙ্গী। পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহীন ও ১১ বছর বয়সে পিতৃহীন বেকের জন্মেছিলেন ১৮৩৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। মামা দোন হুয়ান বার্গাসের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনা করেছেন সান তেলমো কলেজে। চেয়েছিলেন বাবার মতো
চিত্রশিল্পী হতে, কিন্তু হলেন কবি। কিন্তু ৩৪ বছরের স্বল্পায়ুর জীবনে কবিতার কোনো বই বের হয়নি। যদিও স্পেনের তৎকালীন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাঁর রিমাগুলো। রিমার বাইরে লিখেছেন কিংবদন্তি, তাও আসলে গদ্যের মুখোশে কবিতারই সম্প্রসারণ। মুগ্ধ ছিলেন ভারতীয় পুরাণ এবং কিংবদন্তি দ্বারা। তাঁর দুটো কিংবদন্তির বিষয় ভারতীয় পুরাণ ও ঐতিহ্য—একটির নাম ‘সৃষ্টি: ভারতীয় কবিতা’, অন্যটি, ‘রাতুল হাতের গোষ্ঠীপতি: ভারতীয় ঐতিহ্য’। দ্বিতীয়টিতে ভারত, নেপাল, মিয়ানমার এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা অঞ্চলের উল্লেখ যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ঢাকা শহরের উল্লেখও। ১৮৭০ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে গুস্তাবো আদোল্ফো বেকের মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলা ভাষায় আমি তাঁর কোনো কবিতা এ পর্যন্ত
অনূদিত হতে দেখিনি। তাঁর একটি মাত্র লেখা ‘স্বর্ণ বলয়’ নামে অনূদিত হয়েছিল, যা অসিত সরকার সম্পাদিত ‘সাত সমুদ্র সাত আকাশ’ গ্রন্থে দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে
দেখেছিলাম।

==========================

গুস্তাবো আদোলেফা বেকেরের কবিতা
স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: রাজু আলাউদ্দিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
তারিখ: ২৯-১০-২০১০

==========================

বাদামি চড়ুই পাখি ফিরে আসবে
———————————————–

বাদামি চড়ুই পাখি তোমার ব্যালকনিতে
আবারও আসবে ফিরে নীড় রচনায়,
আবারও খেলাচ্ছলে ডানা দিয়ে টোকা দেবে তারা
তোমার ঘরের জানালায়;
কিন্তু যারা তোমার সুষমা আর আমার নিয়তি
দেখার জন্য ডানা গুটিয়ে নিয়েছে
আর যারা জেনেছিল আমাদের নাম
তারা…ফিরে আসবে না!

গভীর সুগন্ধিলতা বাগান-প্রাচীর বেয়ে উঠবে আবার
তাদের কুসুমগুলো বিকেলবেলার
আরও বেশি শোভা নিয়ে ফুটবে আবার
কিন্তু সেই সুমধুর শিশিরপুঞ্জ
যাদের দেখেছি আমি ঝরে যেতে ফোঁটায় ফোঁটায়
দিবসের কান্নার মতো
তারা…আর ফিরে আসবে না!

প্রেমের আগুন-ভরা শব্দগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে
ফিরে আসবে তোমার শ্রুতিতে
হয়তো বা তোমার হূদয়
গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠবে আরও একবার
কিন্তু নীরবে, নিমগ্ন নতজানু
ঈশ্বরের সমর্পিত বান্দার মতো
যেভাবে তোমাকে আমি ভালোবেসেছি
সেভাবে তোমাকে কেউ কোনোদিন ভালোবাসবে না।
==============================

রিমা
——————————————————
১৭
আমায় দেখে হাসছে আজ বিশ্বচরাচর
আজকে আমার প্রাণের মাঝে রবিকরোজ্জ্বল
দেখেছি আজ তারে আমি, আমায় সে দেখেছে
আজকে আমার আস্থা এল প্রভু নিরঞ্জনে!

২১
কবিতা তাহলে কী? আমার দুই চোখে
তোমার সুনীল দুই চোখ রেখে জানতে চেয়েছ।
তুমি কিনা জানতে চাও…
কবিতা কী?
কবিতা…সে তো তুমি!

২২
যে-গোলাপ তুমি ফুটিয়ে রেখেছ তোমারই প্রাণের পাশে
বাঁচে সে কেমন করে?
পৃথিবীতে আমি দেখিনি কখনো অগ্নিগিরির ’পরে
কুসুমের বেঁচে থাকা।

২৩
এক নজরের জন্য তোমায় একটি ভুবন;
একটি মৃদু হাসির তরে একটি আকাশ;
একটি চুমুর জন্য তবে…জানি না তোমায়
কী দেব হায় একটি চুমুর তরে!

৩৮
দীর্ঘশ্বাস বাতাসে গড়া, বাতাসেই যায় ভেসে।
অশ্রুকণারা জলের, তারা সমুদ্রে যায় মিশে
বলো, তবে নারী প্রেম ভুলে গেলে,
জানো, সে কোথায় যায়?

৬০
জীবন আমার ঊষর পোড়োভূমি:
যে-পুষ্প ছুঁই ওমনি সে যায় ঝরে
আমার ভাগ্য-সড়কে কেউ দুর্ভাগ্যকে বোনে
চলার পথে আমি যাতে এসব তুলতে পারি।

৭৯
এক নারী বিষাক্ত করে গেছে আত্মা আমার;
অন্যজন বিষাক্ত করে গেছে আমার শরীর:
দুজনের কেউ খুঁজতে আসেনি আমাকে;
এদের কারোর প্রতিই আমার কোনো অভিযোগ নেই।

জগৎ যেহেতু গোলাকার আর ঘূর্ণায়মান
কাল যদি, ঘুরে ঘুরে এই বিষ উৎসেই ফিরে যায়,
তাহলে আমায় কেন অভিযোগ করা?
আমায় যা দিয়েছিল তারও বেশি আমি পারব কি দিতে?

=====================================

মন্তব্য করুন